কলকাতা: আনুষ্ঠানিক সূচনা হল 'আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা-২০২২' এর। সোমবার বিকাল ৪ টা নাগাদ সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্ক ময়দানে ৪৫ তম বইমেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ৪৫ বার কাঠের ঘণ্টা বাজিয়ে মেলার সূচনা করেন তিনি।
এদিনের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ এমপি, বাংলার সাংস্কৃতিক মন্ত্রী ও গায়ক ইন্দ্রনীল সেন, পরিবহন মন্ত্রী ও কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম, দমকল মন্ত্রী সুজিত বসু, বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, গ্রন্থাগার মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী, বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখিকা ও বাংলা একাডেমীর সভাপতি সেলিনা হোসেন, ভারতের বিশিষ্ট লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, কবি সুবোধ সরকার, তৃণমূল বিধায়ক ও গায়িকা অদিতি মুন্সী, বাংলাদেশের সঙ্গীতশিল্পী অদিতি মহসিন, সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, চিত্রশিল্পী শুভা প্রসন্ন, কলকাতাস্থ বাংলাদেশের উপ হাইকমিশনার তৌফিক হাসান, কলকাতা বইমেলার আয়োজক সংস্থা ‘কলকাতা বুক সেলার্স আ্যন্ড গিল্ড’- এর সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চ্যাটার্জি, গিল্ডের সভাপতি সুধাংশু শেখর দে প্রমুখ।
মেলার আনুষ্ঠানিক সূচনা করে মমতা বলেন, "এবারে বাংলাদেশ থিম কান্ট্রি। বাংলাদেশ ও বাংলা একই ভাষায় কথা বলতে পারা, হৃদয়ের কথা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারা, এই দুটোর মধ্যে যে প্রাণের স্পন্দন-এটাই হচ্ছে আমাদের বাংলা ও বাংলাদেশ। আমি কখনও এই দুটির মধ্যে পার্থক্য করতে পারিনা। যদিও বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য। কিন্তু দুই বাংলার সম্পর্কের সীমানা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। দুই দেশের মধ্যে তারকাঁটার বেড়া আছে, কিন্তু আমার মনে হয় বাংলাদেশের অনেক ঐতিহ্য এখানে পড়ে আছে, আবার এপার বাংলার অনেক ঐতিহ্য ওখানে পড়ে আছে।"
মমতা আরও বলেন, "বাংলাদেশের সাথে এই বাংলার সম্পর্ক চির মধুর। আমরা একে অপরের চিরসাথী। আমরা সকলেই সেদেশের জাতির পিতা মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা করি। আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি। সেই সাথে বাংলাদেশের ভাই-বোনেদের শুভেচ্ছা জানাই। আমি চাই আগামী দিনেও আমাদের সম্পর্ক যেন অটুট ও সুন্দর থাকে।"
সল্টলেকের এই মেলা প্রাঙ্গণটিকেই এদিন "স্থায়ী বইমেলা প্রাঙ্গন" করার ঘোষণাও দেন মুখ্যমন্ত্রী। এর আগে মঞ্চে উপস্থিত মুখ্যমন্ত্রী, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী, কবি, সাহিত্যিক সহ সমাজের বিশিষ্টদের হাতে স্মারক উপহার তুলে দেওয়া হয় বইমেলা আয়োজক কমিটির তরফে।
বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতাবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, সেদেশের মুক্তিযোদ্ধা, ভাষা শহীদ ও এদেশের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী কেএম.খালিদ জানান, "এমন একটা সময় বাংলাদেশকে থিম কান্ট্রি করা হয়েছে যখন একইসাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পকের ৫০ বছর উদযাপন করছি। দুই দেশের সম্পর্কে সৌহার্দের, ভ্রাতৃত্বের। এই সম্পর্ক ঐতিহাসিক, আত্মিক ও রক্তের বন্ধনে আবব্ধ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারত লাখ লাখ শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতেও ভারতের অসামান্য অবদান ছিল।"
তার অভিমত, "কলকাতা পুস্তক মেলা বিশ্বের অন্যতম বইমেলা হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। এটি ভারত বা পশ্চিমবঙ্গের মেলা হলেও বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বিশেষ করে বাংলাদেশের নিকট অতি গুরুত্বপূর্ণ বইমেলা হিসাবে সমাদৃত হয়ে আসছে। দুই বাংলার শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি একই সূত্রে গাঁথা।"
এর আগে স্বাগতিক ভাষণে গিল্ডের সভাপতি সুধাংশু দে জানান, "করোনার কারণে গত বছর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। এবারও করোনার কারণে বুক স্টলের আয়তন ৩৫% কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারকে স্বাগত জানাই, যারা আমাদের নিরন্তর সহয়তা করে চলেছেন।"
গিল্ডের সম্পাদক ত্রিদিব চ্যাটার্জী বলেন, "এনিয়ে তৃতীয় বারের জন্য কলকাতার বইমেলার থিম কান্ট্রি হয়েছে বাংলাদেশকে। এনিয়ে আমরা সত্যিই গর্বিত। এই বইমেলা গোটা বিশ্বের মধ্যে একমাত্র উন্মুক্ত বইমেলা। করানোর কারণে গত বছর এই মেলা করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু মূখ্যমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টাও এটা হয়েছে।"
সেলিনা হোসেন বলেন, "বইমেলার আয়োজন কেবল মাত্র উৎসব নয়। এটি চেতনার পবিত্র শিক্ষা- যে শিক্ষা থেকে আলোকজ্জল হয়ে ওঠে সমাজ, পরিবেশ, রাষ্ট্রব্যবস্থা। সঞ্জীব চটোপাধ্যায় বলেন, "আজকে দুই বাংলা মিলে একটা উৎসব পালন করছেন যেটা বইমেলা। এই মেলা যেন সার্থক হয়।"
এদিন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী তিনটি বই মুখ্যমন্ত্রীর হাতে উপহার স্বরূপ হিসাবে তুলে দেন। মূল অনুষ্ঠান শেষে দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। পরে বাংলাদেশী শিল্পীদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও করা হয়।
এই বইমেলা চলবে আগামী ১৩ মার্চ পর্যন্ত। বইমেলা খোলা থাকবে দুপুর ১২ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত। কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য বিধি মেনেই বইমেলার আয়োজন করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে যতটা সম্ভব খোলা-মেলা করা হয়েছে বইমেলা প্রাঙ্গণ।
বাংলাদেশর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী-কে সামনে রেখেই এবারের কলকাতা বইমেলার থিম কান্ট্রি বাংলাদেশ। স্বাভাবিক ভাবেই এবারের বইমেলায় প্রায় সাড়ে চার হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে তৈরি হয়েছে সুবিশাল বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন। এটি তৈরি করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের যে আদল, তাকে সামনে রেখেই। এদিন সন্ধ্যায় এটি উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের সংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী।
আগামী ৩ ও ৪ মার্চ বইমেলায় পালিত হবে ‘বাংলাদেশ দিবস’। ওই দুই দিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু এবং সেই সাথে বাংলাদেশের বর্তমান অর্জন, বিভিন্ন ঐতিহ্যের প্রতিফলন, তরুণ প্রজন্মের কাছে তার প্রাসঙ্গিকতা এই সমস্ত বিষয় নিয়েই আলোচনা হবে। উপস্থিত থাকবে সেদেশের বিভিন্ন জগতের বিশিষ্টরা। বইমেলার বিশেষ আকর্ষণ কলকাতা লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল উদযাপন হবে আগামী ১১ ও ১২ মার্চ। যদিও তা হবে অনলাইন ও অফলাইন পদ্ধতির সংমিশণে।
এবারের আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার প্রবেশদ্বার (গেট) করা হয়েছে মোট ৯ টি, যার মধ্যে তিনটি গেট নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বই, সুবর্ণ জয়ন্তীর আবহের উপর ভিত্তি করে। এবারের বইমেলায় বাংলাদেশের প্রায় ৪২ জন প্রকাশন অংশ নিচ্ছে, স্টল থাকছে ৮৫ টির মতো। গোটা বইমেলায় স্টল থাকছে প্রায় ৬০০, এর মধ্যে লিটল ম্যাগাজিন স্টলের সংখ্যা থাকছে ২ শতাধিকের মতো।
বাংলাদেশ ছাড়াও বইমেলায় অংশ নিয়েছে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইতালি, ইরান, স্পেন, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো এবং লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশ। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের অন্য রাজ্য থেকেও প্রকাশকরা এই বইমেলায় যোগ দিয়েছেন।
No comments:
Post a Comment