সোনার কারিগর থেকে কোটিপতি অপহরণ মামলায় গ্রেফতার হওয়া তৃণমূল কাউন্সিলর মিলন
নিজস্ব সংবাদদাতা, উত্তর ২৪ পরগনা, ২১ সেপ্টেম্বর: রাজ্যে তিনিই প্রথম তৃণমূল কাউন্সিলর যিনি ব্যবসায়ীকে অপহরণ মামলায় সিআইডির হাতে বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেফতার হয়েছেন। ব্রিটিশ শাসন আমলের পুরসভা বারাসতের ইতিহাসে যে কোনও ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া কাউন্সিলর হিসেবেও তিনিই প্রথম। বারাসত পুরসভার চেয়ারম্যান বলেন, "এই ঘটনায় পুরসভা কালিমালিপ্ত হয়েছে।"
সিআইডি সূত্রের খবর, খড়দা থানা এলাকার এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ মামলায় বৃহস্পতিবার রাতে বারাসত পুরসভার দুই নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মিলন সরদারকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। শুক্রবার তাকে ব্যারাকপুর আদালতে তোলা হলে আদালত নয় দিনের সিআইডি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে।
তৃণমূল সূত্রের খবর, ১৫ সালের পুরসভা নির্বাচনে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে প্রথমবার জেতেন মিলন সরদার। সেসময় তিনি বারাসতের একটি গহনা তৈরির কারখানায় কারিগরের কাজ করতেন। কাউন্সিলর হয়ে ছেড়ে দেন সেই কাজ। পুরসভা ও তৃণমূল সূত্রের দাবি, ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সরকারি বাড়ি দিতে শতাধিক পারিবের থেকে মাথাপিছু আট হাজার টাকা নিয়েছিলেন। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র ক্ষোভ তৈরি হয় এলাকায়। রাস্তা অবরোধ করেন স্থানীয়রা। হামলা হয় মিলনের বাড়িতে। পরিস্থিতি খারাপ বুঝে কিছু দিনের জন্য বাড়ি ছাড়েন মিলন।
বারাসত পুরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান সুনীল মুখোপাধ্যায় বলেন, "সঠিক সংখ্যা জানিনা তবে টাকা নিয়েছিল মিলন। পরে সেই টাকা কয়েকজনকে ফেরৎ দেয় সে। " নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তৃণমূলের এক নেতার দাবি , মিলন সরদার কাউন্সিলর হয়ে বারাসত ব্যারাকপুর রোডের টালিখোলা এলাকায় জমি লিজ নিয়ে পোশাকের হাট বসিয়ে ব্যবসা শুরু করে। হাটের অদূরে সাট্টা র্যাকেটও চালায় । ওই নেতার দাবি শুধু মিলন একা নন, তৃণমূলের অপর এক কাউন্সিলর, কয়েকজন নেতা এবং দুষ্কৃতীদের নিয়ে সাট্টা র্যাকেট থেকে তোলাবাজি সবই করত মিলন।
বারাসত পুরসভার এক কাউন্সিলরের দাবী, মিলন যখন প্রথমবার কাউন্সিলর তখন ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। দুই দফায় কাউন্সিলর থাকাকালীন সময়ে ৩৩ ওয়ার্ডে ছয়টি বাড়ি ও ২ নম্বর ওয়ার্ডে দু'টি বাড়ি তৈরি করেছে সে। এমনকি বেশ কয়েকটি জমিও কেনে। যদিও প্রতিবেদকের হাতে আসা দু'টি জমির মালিকানা নথিতে নাম আছে মিলনের। বর্তমানে দুই নম্বর ওয়ার্ডের বসবাসের বাড়িটি নিজের। তবে বাকি বাড়ি গুলোর মালিকানা নথির খোঁজ মেলেনি।
বিরোধী বিজেপি ও বামেদের দাবি, দুই নম্বর ওয়ার্ডের সরকারি বাড়ি প্রদানে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল মিলনের বিরুদ্ধে। ২২ সালের পুরসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রকাশ করা প্রথম তালিকায় নাম ছিল না তার। পরে টাকার বিনিময়ে টিকিট পান দ্বিতীয় তালিকায়। প্রথম তালিকায় দুই নম্বর ওয়ার্ডের টিকেন্দ্রনাথ সরকার নামে এক তৃণমূল কর্মীর নাম। পুরসভা নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হন তিনি।নির্বাচনের আগের দিন মিলন বাহিনীর হাতে মারধর খেয়ে আহত হন টিকেন্দ্রনাথ। তৃণমূল সূত্রের দাবি, মিলনের টিকিট পেতে নেতৃত্বের কাছে দরবার করেন বারাসত পুরসভার চেয়ারম্যান অশনি মুখোপাধ্যায়।
সিআইডি ও তৃণমূল সূত্রের দাবী, মিলনের সাথে উত্তর ২৪ পরগনা এবং পড়শি জেলার দুষ্কৃতিদের সাথেও যোগাযোগ ছিল বলে বিভিন্ন মহল থেকে খবর পাচ্ছেন তারা। সূত্রের দাবী, দুষ্কৃতীদের থেকে সোনা আসত মিলন বাহিনীর হাতে। সেই সোনা গলিয়ে বিক্রি করত মিলন। সোনা বিক্রির ভাগ পেত সে। ব্যারাকপুর রোডের টালিখোলার হাট ছিল কালো টাকার সাদা করার ক্ষেত্র।
অশনি বলেন, মিলন কাউন্সিলর ছিলেন। তালিকা একটাই আমাদের কাছে এসেছিল সেখানে মিলনের নাম ছিল দুই নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী হিসেবে। বারাসতে কোনও কাউন্সিলরকে প্রার্থী না করার ঘটনা ঘটেনি। ফলে অভিযোগ সত্যি নয়।
বারাসত পুরসভার বিরোধী মুখ তথা সিপিএম কাউন্সিলর বরুন ভট্টাচার্য বলেন, " ভাবতে অবাক লাগে মিলন সরদারের মত সমাজ বিরোধীর সঙ্গে এক সাথে পাশাপাশি বসে বৈঠক করেছি পুরসভায়। সোনার দোকানের কারিগর কাউন্সিলর হয়ে একাধিক বাড়ি, ফ্লাট, গাড়ি ও জমি কিনেছেন। কোটি কোটি টাকার মালিক সে। কাউন্সিলর অপহরণকারী অভিযোগ গ্রেফতার হয়েছে। তৃণমূল এদের টিকিট দিয়ে দূর্নীতি করে।"
সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সম্পাদক মণ্ডলির সদস্য আহমেদ আলি খান বলেন, "মিলনের অসৎ উপায়ে তোলা টাকা তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে যেত।"
বিজেপি নেতা তাপস মিত্র বলেন, "তৃণমূলে তোলাবাজ এ চোর ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে অপহরণকারীও আছে।ত্রিপুরার ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে নয় কোটি টাকা নিয়ে দলের নেতাদের ভাগ দিয়েছে। নিজে সম্পত্তি বাড়িয়েছে। মিলনের সাথে বারাসত পুরসভার চেয়ারম্যান অশনি মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।"
বারাসত পুরসভার চেয়ারম্যান অশনি মুখোপাধ্যায় বলেন, " মিলন সরদার একজন কাউন্সিলর। আমার সহকর্মী। আমি চেয়ারম্যান। এর বাইরে কোনও সম্পর্ক নেই। ব্যক্তিগত ভাবে কে কোথায় কি করছে তা জানার কাজ আমার নয়।"
বারাসত জেলা তৃণমূলের সাংগঠনিক সভাপতি সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার বলেন, "দল বিরোধী ও দলীয় নীতি অনুশাসনের বাইরে কাজ করায় দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে।"
No comments:
Post a Comment