কৌশিক অমাবস্যায় তারা মায়ের অপরূপ বেশ, মন্দিরে উপচে পড়া ভিড় পুণ্যার্থী-তন্ত্রসাধকদের
নিজস্ব সংবাদদাতা, বীরভূম, ১৪ সেপ্টেম্বর: আজ বৃহস্পতিবার, কৌশিকী অমাবস্যা। সেই উপলক্ষে তারাপীঠে উপছে পড়ছে পুণ্যার্থীদের ভিড়। আজ দিনভর প্রায় পাঁচ লক্ষেরও বেশি পুণ্যার্থী তারাপীঠ মন্দিরে এসেছেন। কথিত আছে পুরাকালে শুম্ভু-নিশুম্ভ নামে দুই অসুরের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল দেবতা কুল। দেবতাকুল মহাদেবের শরণাপন্ন হলে, মহাদেব দেবী দুর্গাকে শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করার অনুরোধ করেন। সেই মতো দেবী দুর্গার কোষ থেকে দেবী কৌশিকীর উৎপত্তি হয় এবং শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করেন। রক্ষা পায় দেবকুল। সেই দিনটি ছিল অমাবস্যার তিথি, তাই এই অমাবস্যা কৌশিকী অমাবস্যা নামে অভিহিত।
তারাপীঠের মহাশ্মশানে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন ব্রহ্মার সপ্তম মানসপুত্র বশিষ্ঠ মুনি। কৌশিকী অমাবস্যার তিথিতে তারাপীঠের মহাশ্মশানে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন সাধক বামদেব। তাই 'সিদ্ধপীঠ' নামে অভিহিত হয়েছে বীরভূমের তারাপীঠ। বশিষ্ঠ মুনি থেকে শুরু করে সাধক বামাক্ষ্যাপার অলৌকিক কাহিনী বিজড়িত মা তারার এই প্রাঙ্গণ। ঐতিহ্যবাহী তারাপীঠে মানুষজন যে শুধু ভক্তির টানেই ছুটে আসেন তা নয়, ভারত-সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইতিহাসের টানেও এখানে ছুটে আসেন অনেকেই। দেবীর আবির্ভাব ও পৌরাণিক কাহিনী বর্ণিত আছে তারাপীঠের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
সমুদ্র মন্থনের সময় বিষ পান করে মহাদেব শিথিল হয়ে পড়েছিলেন। দেবী দুর্গা, মা তারা রূপে মহাদেবকে স্তন্যপান করিয়েছিলেন। শুক্লা চতুর্দশীর দিন সেই মা তারা রূপেই বশিষ্ঠ মুনিকে দেখা দিয়েছিলেন তিনি। সেই থেকে এই স্থানের নাম হয় তারাপীঠ। তবে আরও ভিন্ন ভিন্ন মতও রয়েছে। বলা হয়, বিষ্ণুর চক্রে সতীর দেহ যখন খণ্ড খণ্ড হয়ে গিয়েছিল, সেই সময় চোখের মণি বা তারা এখানে পড়েছিল। এর বাইরেও আরও পৌরাণিক মত রয়েছে।
তারাপীঠে মা তারার প্রথম মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তারাপীঠ মহাশ্মশানে। দ্বারকা নদীর বন্যার জলে সেই মন্দির বারবার ভেঙে যাওয়ায় শ্মশান থেকে কিছুটা দূরে উঁচু জায়গায় নতুনভাবে মন্দির নির্মাণ করে সেই মন্দিরে মা তারাকে অধিষ্ঠিত করা হয়। তারাপীঠের বর্তমান মা তারার মন্দিরটি ১৮১৮ সালে বীরভূমের মল্লারপুরের জমিদার জগন্নাথ রায় নির্মাণ করেছিলেন। এই তারাপীঠ আরও খ্যাতিলাভ করে সাধক বামাক্ষ্যাপার ভক্তি ও অলৌকিক কাহিনী সমূহের মধ্যে দিয়ে।
১৮৩৭ সালে শিবচতুর্দশীর তিথিতে তারাপীঠ সংলগ্ন আটলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বামাচরণ চট্টোপাধ্যায়। ছোট বেলায় তারাপীঠের দ্বারকা নদীর তীরে মহাশ্মশানে তিনি চলে আসেন। সেখানেই সাধনা করে বামদেব মা তারার দর্শন পান এবং সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। সেই দিনটি ছিল ভাদ্র মাসের কৌশিকী অমাবস্যা। সেই প্রাচীন কাল থেকে আজও এই কৌশিকী অমাবস্যার তিথিতে তারাপীঠ মহাশ্মশানে তন্ত্র সাধনা করতে আসেন বহু তন্ত্রসাধক। অমাবস্যার তিথির নিশিরাতে তারাপীঠের মহাশ্মশানে জ্বলে ওঠে হাজারে হাজারে হোমকুণ্ড। এই বিশেষ দিনে মনস্কামনা পুরনের আশায় মা তারার পুজো দিতে লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী। তারাপীঠে মা তারার দর্শন করতে গেলে 'সাধক বামাক্ষ্যাপার' জন্মভিটেও দর্শন করেন ভক্তরা।
আজ ভোর ৪:৩১ মিনিটে অমাবস্যা তিথি শুরু হয়েছে। তার আগে মা তারার ব্রহ্ম শিলামূর্তিকে স্নান করানো হয়েছে। তারপর ফুল ও স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে রাজ রাজেশ্বরী বেশে সাজানো হয় মাকে। এরপর শুরু হয় মঙ্গলারতি। মঙ্গলারতির পর পুণ্যার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয় মন্দিরের গর্ভগৃহের দরজা। তারপর থেকেই মা তারাকে পুজো দিতে পারছেন তারা। আজ দুপুরে মা তারাকে অন্নভোগ নিবেদন করার আগে ফের মা তারাকে সাজানো হয়েছে। গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ করে সবার অন্তরালে দেবীকে ভোগ নিবেদন করা হয়। এই সময় মন্দিরের দুটি দরজা বন্ধ রাখা হয়।
এদিনের ভোগে ছিল পোলাও, ফ্রায়েড রাইস, ভাত , ডাল, পাঁচ রকমের ভাজা, পাঁচ রকমের তরকারি, মাছ, বলির পাঁঠার মাংস, শোলমাছ পোড়া, পাঁচ রকমের মিষ্টি, পায়েস ও কারন। ভোগ নিবেদনের পর ফের মন্দির খুলে দেওয়া হয়েছে পুণ্যার্থীদের জন্য। সন্ধ্যায় মা তারাকে শোলার ডাকের সাজে সাজানো হবে। সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টায় শুরু হবে মঙ্গল আরতি। মঙ্গল আরতির পর মা তারাকে খই, মুড়কি, বাতাসা, লুচি ও মিষ্টি দিয়ে শীতল ভোগ নিবেদন করা হবে। তারপর রাত নটার পর মা তারার বিশেষ পুজো হবে। রাত বারোটার পর মা তারাকে খিঁচুড়ি ও পাঁচ রকম ভাজা দিয়ে ভোগ নিবেদন করা হবে।
আজ সারা রাত মন্দির খোলা থাকবে। পুণ্যার্থীরা সারারাত মা তারাকে পুজো দিতে পারবেন। ভোর তিনটে নাগাদ এক ঘন্টার জন্য দেবীকে শয়নে রাখা হবে। সেই সময় মন্দিরের দুটি দরজায় বন্ধ রাখা হবে। তারপর পুণ্যার্থীদের পুজো দেওয়ার জন্য ফের খুলে দেওয়া হবে দরজা।
মন্দিরের পাশে থাকা তারাপীঠ মহাশ্মশানে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে হোমযজ্ঞ। সন্ধ্যার পর সেই হোমযজ্ঞের সংখ্যা আরও বাড়বে। এই কৌশিকী অমাবস্যার তিথিতে তারাপীঠ মহাশ্মশানে তন্ত্র সাধনা করতে এসেছেন বহু তন্ত্র সাধক। তারাপীঠের মূল মন্দির সাজানো হয়েছে ফুলের মালা দিয়ে। মন্দির চত্ত্বর সাজিয়ে তোলা হয়েছে রংবেরঙের আলো দিয়ে। বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। প্রবেশ পথগুলিতে বসানো হয়েছে মেটাল ডিটেক্টর গেট। নিরাপত্তার জন্য রয়েছে ১০০০ পুলিশ কর্মী, ১৭০০ জন সিভিক ভলেন্টিয়ার ও মন্দির কমিটির ১৭৫ জন বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মী।
No comments:
Post a Comment