তৃতীয় দফায় বোমাবাজি, সংখ্যালঘুদের ভোট দিতে বাধা
কলকাতা: বিক্ষিপ্ত কিছু হিংসা, অশান্তি ছাড়া নির্বিঘ্নেই শেষ হল লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় দফার ভোটগ্রহণ। মঙ্গলবার এদফায় ভোট নেওয়া হয় ১১ টি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলের মোট ৯৩ টি কেন্দ্রে। ভোট গ্রহণ শুরু হয় সকাল ৭ টায়, তা চলে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।
মোট সাত দফায় দেশের ৫৪৩ টি লোকসভা আসনে ভোট নেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে প্রথম তিন দফার ভোটের মধ্যে দিয়েই অর্ধেকের বেশি আসন অর্থাৎ ২৮৩ আসনে ভোট নেওয়া সম্পন্ন হল। বাকি থাকবে আরও চার দফা। চতুর্থ দফার ভোট নেওয়া হবে আগামী ১৩ মে, পঞ্চম দফা ২০ মে, ষষ্ঠ দফা ২৬ মে এবং সপ্তম ও শেষ দফার ভোট ১ জুন। গণনা আগামী ৪ জুন।
তৃতীয় দফায় এদিন ভোট নেওয়া হয় গুজরাট (২৫), কর্ণাটক (১৪), মহারাষ্ট্র (১১), উত্তর প্রদেশ (১০), মধ্যপ্রদেশ (৯), ছত্রিশগড় (৭), বিহার (৫), অসম (৪), পশ্চিমবঙ্গ (৪), গোয়া (২), দাদরা এবং নগর হাভেলি, দমন এবং ডিউ (২) আসনে।
এদফায় বাংলার চারটি কেন্দ্রে ভোট নেওয়া হয়; সেগুলি হল- মালদা উত্তর, মালদা দক্ষিণ, জঙ্গিপুর এবং মুর্শিদাবাদ। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে এই কেন্দ্রগুলিতে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। ভোটে কোনও রকম অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকেও সমস্ত পদক্ষেপ করা হয়েছিল।
ভোটকে কেন্দ্র করে বড় কোনও গন্ডগোল বা সহিংসতার খবর না ঘটলেও ছোটখাটো দুই-একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে। জঙ্গিপুর আসনের অন্তর্গত সুতির ৬৪ নম্বর বুথের বাইরে তৃণমূল কংগ্রেস ব্লক সভাপতি গৌতম ঘোষের সাথে বচসায় জড়িয়ে পড়েন ওই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী ধনঞ্জয় ঘোষ। তৃণমূল কর্মীর অভিযোগ, বিজেপি প্রার্থী ভোটারদের প্রভাবিত করছে। ধনঞ্জয়ের পাল্টা অভিযোগ, তার দলের পোলিং এজেন্টকে বুথ থেকে বের করে দেওয়া হয়। আর সেই খবর পেয়ে ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে যান তিনি। একসময় দুজনই একে অপরের দিকে তেড়ে যান। পরে নিরাপত্তা রক্ষীরা তাদের সরিয়ে দেন।
মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রের রানীনগরে বুথের বাইরে সিপিআইএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিমকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখানো হয়। তৃণমূলের কর্মীরা 'গো ব্যাক' স্লোগান দেয় বলে অভিযোগ। এই কেন্দ্রের গোপীনাথপুরে ভুয়া এজেন্ট ধরেন সিপিআইএম প্রার্থী। ডোমকলের ঘোড়ামারায় বিরোধী ভোটারদের বুথে যেতে বাধা দেওয়া হয় বলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ। রানীনগরের মরিচা-নিচুপাড়ায় ১৬৮ নম্বর বুথে তৃণমূল কর্মীর বাড়ি লক্ষ্য করে বোমাবাজির অভিযোগ ওঠে কংগ্রেস-বাম জোটের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় দুজনকে আটক করা হয়।
উত্তর মালদার রতুয়ার রামপুর এলাকায় এটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের বাইরে বোমাবাজির ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ। যদিও এই ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। পাশাপাশি একাধিক জায়গায় ভোটারদের ভয় দেখানোর অভিযোগ এসেছে। এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন নির্বাচন কমিশন। জেলা নির্বাচনী আধিকারিকের কাছ থেকে রিপোর্ট তলব করে।
গুজরাটের গান্ধীনগরে একটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে বিজেপির প্রতীক পদ্মফুল লাগানো কলম ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ করেন সে রাজ্যর কংগ্রেস সভাপতি শক্তিসিং গোহিল। তাঁর অভিযোগ, বিজেপি হেরে যাবে বলেই এই ধরনের অনৈতিক পদ্ধতি অবলম্বনে করেছে।
এদিকে তৃতীয় পর্বের ভোট চলাকালীন সময়ে পুরুলিয়ার একটি নির্বাচনী প্রচারণা থেকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মারাত্মক অভিযোগ তোলেন। তাঁর অভিযোগ, 'উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের ভোট দিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। প্রচারের ফাঁকে কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজের বক্তব্য থামিয়ে মোবাইলের মেসেজে চোখ বোলান। এরপরই তিনি বলেন, 'উত্তরপ্রদেশে সংখ্যালঘুদের ভোট দিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আমি এখনই জানতে পারলাম। সেখানে ভোট দিতে যাওয়া একজনকে পিটিয়ে রোদ্দুরে ফেলে রাখা হয়েছে।' নির্বাচন কমিশনকে নিশানা করে মমতার বক্তব্য, 'আপনারা কী ভাবছেন এই ঘটনায় নির্বাচন কমিশন বিজেপির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করবে? আসলে 'মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট' এখন 'মোদী কোড অফ কন্ডাক্টে' পরিণত হয়েছে। ওরা যা খুশি তাই করছে।'
উল্লেখ্য, এদফায় গোটা দেশ জুড়ে ১,৩৫১ জন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ হয়েছে। হেভিওয়েট প্রার্থীদের মধ্যে ভাগ্য নির্ধারণ হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিজেপি প্রার্থী অমিত শাহ'এর। দ্বিতীয়বারের জন্য গুজরাটের গান্ধীনগর কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। এছাড়াও অন্যদের মধ্যে ছিলেন গুনা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী কেন্দ্রীয় বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, মধ্যপ্রদেশের বিদিশা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী ও রাজ্যটির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান, পোড়বন্দর কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী মানসুখ মান্ডবিয়া, মইনপুরী কেন্দ্রে সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী ও উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের স্ত্রী ডিম্পল যাদব, অসমের ধুবরী কেন্দ্রে 'অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট' (AIUDF) সভাপতি বদরুদ্দীন আজমল, ধারওয়ার কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী কেন্দ্রীয় সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশি।
এদিন সকালে গুজরাটের আমেদাবাদের রানিপ এলাকায় নিশান পাবলিক স্কুলে ভোট দেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ভোট দিয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে মোদী বলেন, 'আজ তৃতীয় দফার ভোটগ্রহণ চলছে। এখনও চার দফার ভোট বাকি রয়েছে। দেশের মানুষকে বলব, তারা যেন তাদের নিজেদের ভোটটা প্রদান করেন।' প্রথম দুটি দফায় প্রায় সহিংসতা বিহীন ভোট পরিচালনা করায় নির্বাচন কমিশনকেও অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রটির বাইরে অসংখ্য মানুষ অপেক্ষা করতে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অভিবাদন গ্রহণ করেন। একসময় একটি ছোট্ট শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে নাচাতে থাকেন প্রধানমন্ত্রী। এই দৃশ্য দেখে উৎসাহী জনতাও হাততালি দিতে থাকেন। এদিকে প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে উপস্থিত সকলকে বেশি পরিমাণে জল খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'বেশি জল খেলে শরীর সুস্থ থাকবে, এনার্জিও পাওয়া যাবে।'
এছাড়াও আমেদাবাদে একটি কেন্দ্রে পরিবারের সকল সদস্যদের নিয়ে ভোট দেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, মহারাষ্ট্রের লাতুরে ভোট দেন অভিনেতা রীতেশ দেশমুখ ও তাঁর স্ত্রী অভিনেত্রী জেনেলিয়া ডিসুজা, মধ্যপ্রদেশের সেহোরে ভোট দেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বিদিশা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী শিবরাজ সিং চৌহান, কর্ণাটকের কালাবুর্গী এলাকায় একটি কেন্দ্রে ভোট দেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে, ভোট দেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র প্যাটেল, গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী প্রমোদ সাবন্ত, আমেদাবাদে ভোট দিতে দেখা যায় আদানি গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান বিশিষ্ট শিল্পপতি গৌতম আদানিকেও।
শেষবার ২০১৯ সালের নির্বাচনে এই ৯৩ আসনের মধ্যে ৭২ আসনে জয়লাভ করেছিল বিজেপি। ৪ টি করে আসনে জয় পায় শিবসেনা এবং কংগ্রেস। জনতা দল ইউনাইটেড এবং ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি ৩ টি করে আসনে জয় পায়। সমাজবাদী পার্টি এবং তৃণমূল কংগ্রেস ২টি করে আসনে জয় পায়। ১টি আসনে জয় পায় লোক জনশক্তি পার্টি এবং বাকি ২টি আসনে স্বতন্ত্র দলের প্রার্থীরা জয়ী হয়। এবার বিজেপির লক্ষ্যমাত্রা ৪০০ আসনে জয়। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য এই দফার ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই রাজ্যগুলিতে বিজেপি তাদের প্রাপ্ত আসন ধরে রাখতে পারবে, না কি বিরোধী দলের জোট 'ইন্ডিয়া' বাজিমাত করবে তা জানা যাবে গণনায়।
প্রসঙ্গত, মুর্শিদাবাদ আসনে তৃণমূলের প্রার্থী আবু তাহের খান, বিজেপি প্রার্থী গৌরীশঙ্কর ঘোষ এবং সিপিআইএম প্রার্থী মোহাম্মদ সেলিম।
মালদা উত্তর আসনে তৃণমূল প্রার্থী প্রাক্তন আইপিএস কর্তা প্রসূন ব্যানার্জি, বিজেপি প্রার্থী খগেন মুর্মু, কংগ্রেস প্রার্থী মোস্তাক আলম।
মালদা দক্ষিণ কেন্দ্রে তৃণমূলের শাহনাজ আলী রায়হান, বিজেপি প্রার্থী শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরী, কংগ্রেসের ইশা খান চৌধুরী।
জঙ্গিপুর কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী খলিলুর রহমান, বিজেপির ধনঞ্জয় ঘোষ, কংগ্রেসের প্রার্থী মোরতাজা হোসেন।
এদফায় গোটা দেশ জুড়ে ১,৩৫১ জন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ হবে। হেভিওয়েট প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিজেপির অমিত শাহ (গান্ধীনগর)। দ্বিতীয়বারের জন্য এই কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে লড়ছেন তিনি। এই কেন্দ্রে তার প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের সোনাল প্যাটেল। ১৯৮৯ সাল থেকেই এই কেন্দ্রটিতে অপরাজিত রয়েছে বিজেপির প্রার্থীরা। গত ২০১৯ সালের নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের সি যে চাভডা'কে ৫.৫ লাখের বেশি ভোটে পরাজিত করেছিলেন অমিত শাহ।
No comments:
Post a Comment