ওয়ার্ড ডেস্ক, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫: বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্রে এসে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি উপস্থিতি, চীন ও রাশিয়ার পাল্টা সক্রিয়তা, ভারতের সরকার বিরোধী অবস্থান—সব মিলিয়ে দেশটি এক অস্থির ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই প্রতিযোগিতার সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা।সমাজ মাধ্যম ফেসবুকে এমন দাবি করেছেন বাংলাদেশের সাংবাদিক শহিদুল হাসান খোকন।
শহিদুল আরও লিখেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল স্পষ্ট বাংলাদেশকে বঙ্গোপসাগরের নতুন কৌশলগত ঘাঁটিতে রূপান্তরিত করা। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন সামরিক পরিবহণ বিমান কিংবা যুদ্ধবিমানের অবতরণ সেই বৃহত্তর পরিকল্পনারই আভাস দিচ্ছে। আমেরিকার লক্ষ্য শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং সমগ্র ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এক নতুন প্রভাব বিস্তার করা। কিন্তু এই পদক্ষেপই বাংলাদেশকে অজান্তে বড় ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে পারে। ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠতার ফলে চীন ও রাশিয়া বাংলাদেশের ওপর পাল্টা চাপ সৃষ্টি করবে। চীনের রয়েছে বিপুল বিনিয়োগ, বন্দর ও অবকাঠামো প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ; রাশিয়া ঐতিহ্যগত প্রতিরক্ষা অংশীদার। ফলে বাংলাদেশ যদি একপক্ষের প্রতি ঝুঁকে পড়ে, তবে অন্য পক্ষ প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবে না। এতে ঢাকার স্বাধীন কূটনৈতিক অবস্থান সংকুচিত হবে এবং সার্বভৌম নীতি কার্যত বিদেশি শক্তির হাতে জিম্মি হয়ে পড়বে।
এই প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ক্ষমতায় বসানোকে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সাফল্য হিসেবে দেখছেন। আন্তর্জাতিক মহলে তাকে দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বা কার্যত এজেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রে তার অবস্থান যত দীর্ঘায়িত হবে, ততই দেশটি মার্কিন স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে। অর্থাৎ, ইউনূসের ক্ষমতার মেয়াদ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংকট, রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও আন্তর্জাতিক চাপ আরও তীব্র হবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য শুধু অর্থনীতি বা সামরিক ঘাঁটি নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতেও বড় পরিবর্তন আনা। বিশেষ করে জামাত ও নতুন গঠিত এনসিপিকে সামনে এনে দেশটিকে ইরান-ধাঁচের একটি “আধুনিক ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র” বানানোর চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ধর্মীয় আবেগকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়ে একটি বিকল্প শক্তি গড়ে তোলা হচ্ছে, যা একদিকে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে দুর্বল করবে, অন্যদিকে বিদেশি স্বার্থ বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। এই প্রকল্পকে পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে অনেকেই এই বৃহত্তর কৌশলের টায়াল বা মহড়া হিসেবে দেখছেন। ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে বিভক্ত করে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে ধর্মভিত্তিক ছাঁচে গড়ে তোলার পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জন্য আরও বড় হুমকি তৈরি করবে।
এই আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের অর্থনৈতিক অভিঘাতও কম নয়। যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা ব্লকের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত—পোশাকশিল্প—প্রথম আঘাত পাবে। আবার চীনের সঙ্গে অতিরিক্ত ঋণনির্ভরতা ভবিষ্যতে ঋণফাঁদের ঝুঁকি তৈরি করবে। বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারালে রপ্তানি কমে যাবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে পড়বে, আর কর্মসংস্থান সংকটে লাখো শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থনীতির এই ধাক্কা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকেও আরও গভীর করবে। বলা যায় বাংলাদেশ এখন পড়েছে এক শাখের করাতের নিচে।
নিরাপত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশ আরও কঠিন অবস্থায় পড়তে পারে। আমেরিকার উপস্থিতি বেড়ে গেলে দেশটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের নতুন টার্গেটে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত অস্থিরতা ও বঙ্গোপসাগরে চীন-ভারতের প্রতিযোগিতা ঢাকার সামরিক ও সীমান্ত নিরাপত্তায় নতুন ঝুঁকি তৈরি করবে। ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠীগুলোর কার্যকলাপ বাড়লে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়বে, এবং বাংলাদেশকে ‘নিরাপত্তাহীন রাষ্ট্র’ হিসেবে বিশ্বের চোখে উপস্থাপন করবে।
রাজনীতিতেও ক্ষতি কম নয়। আওয়ামী লীগকে পরিকল্পিতভাবে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়েছে, বিএনপিকেও কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। ফলে গণতন্ত্রের নামে কার্যত একটি রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতার সুযোগ নিচ্ছে বিদেশি শক্তি। সিদ্ধান্তগুলো আর দেশের ভেতরে গৃহীত হচ্ছে না, বরং বিদেশি চাপ ও স্বার্থের কাছে বাংলাদেশ নতজানু হয়ে যাচ্ছে। জনগণের ইচ্ছা নয়, আন্তর্জাতিক সমীকরণই হয়ে উঠছে মূল চালিকাশক্তি।
এর পাশাপাশি সামাজিক পরিমণ্ডলও ক্ষতির মুখে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান এবং শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রসংসদ নির্বাচনকে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করার প্রবণতা সমাজকে আরও বিভক্ত করছে। তরুণ প্রজন্ম বিভাজনের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বও এক ধরনের অস্থিতিশীল সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে উঠবে। এভাবেই বাংলাদেশ তার সামাজিক ঐক্য ও সহনশীলতা হারাতে পারে।
অর্থনীতি থেকে রাজনীতি, নিরাপত্তা থেকে সমাজ—প্রতিটি স্তরে চাপ বাড়ছে। আর এই চাপের কেন্দ্রবিন্দুতেই রয়েছেন ড. ইউনূস, জামাত-এনসিপি এবং বিদেশি স্বার্থসর্বস্ব রাজনৈতিক পরীক্ষানিরীক্ষা। বাংলাদেশের সামনে তাই আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—নিজেকে অন্যের কৌশলের যন্ত্রে পরিণত না করে স্বাধীন ও স্বার্থকেন্দ্রিক রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকা, এবং ইতিহাসের মতো এবারও ভারতের কৌশলগত সহায়তা পাবে কি না সেই প্রশ্নের উত্তরই খোঁজা!
ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকটময় সময়গুলোতে প্রতিবেশী ভারতই এগিয়ে এসেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত শুধু সামরিক সহায়তাই দেয়নি, কোটি শরণার্থীকেও আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে সবচেয়ে বড় মিত্রে পরিণত হয়েছিল। আজকের পরিস্থিতিতেও প্রশ্ন উঠছে—বাংলাদেশ কি আবারও ভারতের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াবে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কি একাত্তরের ইন্দিরার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বাংলাদেশকে রক্ষা করবেন, না কি দক্ষিণ এশিয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রটি ধীরে ধীরে সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক বা পাকিস্তানের মতো অস্থিতিশীলতার পথে এগিয়ে যাবে?
No comments:
Post a Comment