দক্ষিণ ২৪ পরগনা: আর কিছুদিনের অপেক্ষা, উমা আসছে বাপের বাড়ি। নদী পাড়ে কাশফুলের উঁকিঝুঁকি, মায়ের আগমনী বার্তা। দিকে দিকে চলছে পুজোর প্রস্তুতি। একই ছবি দেখা যাচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একাধিক জমিদার বাড়িতে। আর এই জমিদার বাড়ির দুর্গা পূজা মানেই রয়েছে ইতিহাসের গন্ধ। বিভিন্ন জমিদার বাড়ির আনাচে-কানাচে কান পাতলে এখনও শোনা যায় ইতিহাসের ফিসফাস। তেমনই কাহিনী জড়িয়ে ফলতার মালা গ্রামে দেব সরকার বাড়ির দুর্গা পুজোয়।
২৮১ বছর ধরে ফলতার মালা গ্রামে দেব সরকার বাড়িতে পূজিত হয়ে আসছেন উমা। এই দেব সরকার বাড়ির ইতিহাস বহু পুরনো। কথিত আছে, আনুমানিক প্রায় ৩৫০ বছর আগে পলাশীর যুদ্ধের প্রাক্কালে এই দেব সরকার বংশের উত্থান ঘটে। বিহারীলাল দেব ব্যবসায়িক সূত্রে ফলতার মালা গ্রামে আসেন। তিনি ছিলেন কলকাতার সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়িক পরিবারের সদস্য। তিনি মালা নিবাসী নাগ বংশের মেয়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এখানেই নিজ বসতি নির্মাণ করেন। রাজ প্রাসাদের মতো বড় বাড়িটা ছিল জলাশয় দ্বারা বেষ্টিত। সামনের অংশ ছিল উন্মুক্ত। এই কারণে শত্রুপক্ষ এই বাড়িতে সহজে আক্রমণ করতে পারত না।
কলকাতা থেকে দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবনের লাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য। গাঙ্গেয় জমিতে ধানের সুফলের জন্য ফলতায় বিশাল ধানের আড়ত ছিল এবং ধান ব্যবসার মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল এটি। বিহারীলাল দেব প্রতিষ্ঠা করেন কুলদেবতা শ্রী শ্রী লক্ষ্মীজনার্দন জিউর মন্দির। পরে ব্যবসা এবং জমিদারী বৃদ্ধির পর বিহারীলাল দেবের পুত্র কালিকৃষ্ণ দেব ১১৫২ বঙ্গাব্দে প্রথম এই অঞ্চলে দুর্গা পুজোর প্রচলন করেন। পরে 'সরকার' উপাধিতে ভূষিত করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
এই দেব সরকার বাড়ির দুর্গা পুজোয় রয়েছে এক বিশেষত্ব; প্রতিবছর জন্মাষ্টমীর পরের দিন অর্থাৎ নন্দোৎসবের দিন প্রাচীন কাঠামোর ওপর 'কাঠামো পুজো' করা হয়। এখানে প্রতিমা এক চালার উপর হয়। একটি সুপ্রাচীন বেলগাছে দেবীর বোধন হয়। সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত ১৩১ কিলো চালের নৈবেদ্য হয় এবং বলি প্রথার প্রচলন রয়েছে এই পুজোতে। দুর্গা পুজোর দিনগুলিতে দেব সরকার বংশের সমস্ত পরিবার-পরিজন দেশ-বিদেশ থেকে মালা গ্রামে আসেন। এ বছরেও নবমীর সন্ধায় থাকছে কিছু বিশেষ চমক।
একসময় সাতদিন ব্যাপী যাত্রাপালা ও কবিগান হত এখানে৷ মহিলাদের মনোরঞ্জনের আলাদা ব্যবস্থা থাকত ভিতর মহলে। একসময় ইংরেজ সাহেবরা নিমন্ত্রিত থাকতেন এই দুর্গোৎসবে। চারণকবি মুকুন্দ দাস একসময় পালাগান করেছিলেন এই দেব সরকার বাড়িতেই। এবছর এই পুজো ২৮১ তম বর্ষে পদার্পণ করল। এই বংশের নবম পুরুষ পর্যন্ত এই ঐতিহ্য বংশ পরম্পরায় বজায় রেখে চলেছে। মল্লিকপুরের চক্রবর্তী পরিবার এই দেব সরকার বংশের কুল-পুরোহিত ছিলেন ৷ কিন্তু পরবর্তীকালে, বেলসিংহার মৈত্র পরিবার এই পুজোর পৌরহিত্য করেন।
বর্তমানে, মৃৎশিল্পী শ্রীকান্ত চিত্রকর। তিনিই বংশপরম্পরায় এখানে মূর্তি নির্মাণ করেন। আর ঢুলিদাররা বংশপরম্পরায় চাঁদপালার অদূরে সন্তোষপুর থেকে আসেন। প্রাচীন যুগ থেকেই গ্রামের সাধারণ মানুষ এই দুর্গোৎসবের আনন্দ আস্বাদন করতেন।
No comments:
Post a Comment