প্রেসকার্ড নিউজ বিনোদন ডেস্ক, ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৩০:০১ : বেদের যে লক্ষ্মীর বর্ণনা রয়েছে, তিনি তালাবন্ধ তিজোরির সোনার রাশি নন। তিনি ভগবান নারায়ণের প্রিয়া শ্রীনিধি লক্ষ্মী, যিনি সমৃদ্ধি, শীল ও বিবেকের প্রতীক। দর্শনশাস্ত্রের পণ্ডিত শাস্ত্রী কৌশলেন্দ্রদাসের মতে, দীপাবলি কেবল আলোর উৎসব নয়, এটি মানবজীবনের চিরন্তন সাধনার প্রতীক। মাটির প্রদীপ থেকে অন্তরমনের আলোক পর্যন্ত এই উৎসব মানুষকে স্মরণ করায় চার পুরুষার্থ ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের গভীর তাৎপর্য।
যখন সূর্য অস্ত যায়, চাঁদ ও নক্ষত্রেরা লুপ্ত হয়ে যায়, তখন মাটি, তেল ও তুলোর সংযোগে প্রজ্বলিত ক্ষুদ্র প্রদীপই প্রকৃত আলোর প্রতিনিধি হয়ে মানবচিত্তকে আলোকিত করে। ঋষিদের প্রার্থনা “তমসো মা জ্যোতির্গময়” এই দীপের শিখার মধ্যেই যেন প্রকাশিত হয়। তাই শাস্ত্র প্রদীপকে বলে ‘দীপ দেবতা’ কারণ এই আলোকই জ্ঞানের দেবরূপ।
অন্ধকার যুগে যুগে মানুষের প্রতিপক্ষ। যখন তা হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে, তখন সৌন্দর্য, কোমলতা ও সদ্গুণের জ্যোতি ম্লান হয়ে যায়। কিন্তু প্রদীপের ছোট্ট শিখা জেগে ওঠে অপরাজেয় জিজীবিষা নিয়ে। তেলের স্রোতে জ্বলতে থাকা তুলোর নাড়ি যেন জ্ঞানের ধারা হয়ে প্রকাশ পায়। প্রদীপ তাই শুধু অগ্নির বিন্দু নয় সে নবজাত শিশুর মুখের কোমলতা, লক্ষ্মীর বরদহস্ত, দয়াময় ঈশ্বরের আশীর্বাদ। মুণ্ডকোপনিষদ এ বলা আছে, “যা কিছু দীপ্তিমান, তা পরমেশ্বরের আভা থেকেই জ্বলে ওঠে। এই সমগ্র বিশ্ব সেই এক আলোকেই উদ্ভাসিত। সেই উপনিষদের জ্ঞানই দীপাবলির বাস্তব রূপ।"
দীপাবলির গুরুত্ব এখানেও যে, এর প্রদীপ মাটির তৈরি ধরিত্রীমাতার অঙ্গে জন্ম নেওয়া। এগুলি কোনও অলৌকিক দান নয়, মানব-পুরুষার্থের প্রতিফলন। আচার্য কুবেরনাথ রায় যেমন বলেছেন, “দীপাবলির রজনী হলো মানুষ-নির্মিত আলোর দ্বারা অন্ধকার-বিজয়ের রজনী।” মাটির প্রদীপ তাই পৃথিবীর কন্যা সীতার আপন ভাইয়ের মতো। যখন তারা জ্বলে ওঠে, তারামণ্ডলের আলোও ম্লান হয়ে পড়ে।
কার্তিক অমাবস্যার অন্ধকারে ‘সিন্ধুজা লক্ষ্মী’ পূজার গভীর গূঢ়ার্থ লুকিয়ে আছে। বেদে বর্ণিত লক্ষ্মী সেই সোনা নয় যা তিজোরিতে বন্দি থাকে, বরং তিনি সেই দেবী যিনি গোসেবা, সোনালী শস্য, মধুর অন্নভোগ, শীলযুক্ত দাম্পত্য ও মধুর ভাষার সঙ্গে যুক্ত। প্রকৃত লক্ষ্মীর অর্থ কেবল ধন অর্জন নয়, তার সৎ ব্যবহার কারণ অন্যায়, প্রতারণা ও কদাচারে অর্জিত সম্পদ কখনও লক্ষ্মীর আশীর্বাদ হতে পারে না।
দীপাবলি আমাদের মনে করিয়ে দেয় আসল যুদ্ধ বাইরের অন্ধকারের নয়, বরং নিজের অন্তরের তমসের সঙ্গে। ১৩শ শতকের সুফি সাধক জালালউদ্দিন রুমি বলেছিলেন, “প্রদীপ অনেক, কিন্তু আলো একটাই।” সত্যিই, দীপাবলি কেবল ঘর-আঙিনার সাজ নয়, এটি আত্মার অন্তর্লোকের মহাপর্ব— আত্মজাগরণের দীপাবলি।
No comments:
Post a Comment