মোদীর মন্দির অস্ত্র কি জয়ের হ্যাট্রিক হবে? - press card news

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

Tuesday 6 February 2024

মোদীর মন্দির অস্ত্র কি জয়ের হ্যাট্রিক হবে?


মোদীর মন্দির অস্ত্র কি জয়ের হ্যাট্রিক হবে? 


নিজস্ব সংবাদদাতা, কলকাতা, ০৬ ফেব্রুয়ারি: গত ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবতা প্রভু শ্রী রামচন্দ্রের বিশাল মন্দিরের উদ্বোধন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাত ধরে ওই মন্দির উদ্বোধনের পরেই গোটা দেশজুড়ে তৈরি হয়েছে এক উন্মাদানা। প্রশ্ন একটাই, এই উন্মাদানাকে কাজে লাগিয়ে মোদী কি ২০২৪ সালের লোকসভার নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে পারবেন? 


রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মন্দিরের উদ্বোধন মানুষের মধ্যে স্থায়ী প্রভাব ফেলবে, যার ফলে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ৩০০ টিরও বেশি আসনে জয়লাভের সম্ভাবনা রয়েছে। কেউ কেউ আবার বলছেন আসন সংখ্যা ৩৫০- এর কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে। 


প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এই দাবী করে জানিয়েছেন বিপুল আসনে জয় পেয়ে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসতে চলেছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারতের 'জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট' (এনডিএ)। 


সোমবার লোকসভায় রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে উঠে মোদী জানান, 'এই নির্বাচনে জোট ৪০০ টির বেশি আসন পাবে এবং বিজেপি একাই অন্তত ৩৭০ টি আসন পাবে।' তিনি এও বলেন, 'আমি দেশের পালস অনুমান করতে পারি। গোটা দেশ বলছে, এবার ৪০০ পার। এমনকি কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেও এই কথা বলেছিলেন।'  


এর অন্যতম প্রধান কারণ রাম মন্দির উদ্বোধনের পরই দেশজুড়েই হিন্দু ভাবাবেগ প্রবল হয়ে উঠেছে। সংবিধান মতে ভারত একটি ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ হলেও, ধর্ম নিয়ে যথেষ্ঠ উন্মাদনা রয়েছে দেশে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনে রামমন্দির উদ্বোধনের প্রভাব একেবারেই অস্বীকার করা যায় না। 


কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শুধুই কি মন্দির বা ধর্মের ভিত্তিতে নির্বাচনে জয় আসতে পারে? উন্নয়নের কি কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই? বিশেষজ্ঞদের অভিমত, অন্যদের থেকে এক্ষেত্রে একটু আলাদা মোদী। ভারতের জাতীয় উন্নয়ন অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদ- এই দুইয়ের সমন্বয় হিসাবে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারকে উত্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তাঁর বিশ্বাস এই সমন্বয়ই ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও প্রতিষ্ঠান বিরোধী আবহাওয়াকে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে রূপান্তরিত করতে পারে। 


এই ব্যাপারে অধিকাংশ বিশ্লেষকই একমত। কেউ কেউ আবার ইতিমধ্যেই এই নির্বাচনকে মোদীর নির্বাচন বলে অভিহীত করেছেন। 


অতীতে দেখা গেছে ১৯৮৪ সালে নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস ৪০০ টিরও বেশি আসনে জয়লাভ করে। তারও আগে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থার বিরোধিতা করে ১৯৭৭ সালে কংগ্রেসের থেকে মুখ ফিরিয়ে জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের জোটকে ক্ষমতায় এনেছিল। 


ওই দুইটি জয়ের পিছনেই আবেগ বড় ভূমিকা পালন করেছিল, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে রামমন্দির উদ্বোধনের পর যে উন্মাদনার বলয় তৈরি হয়েছে, আগামী মে মাস ছাড়িয়ে তার রেশ বহুদিন স্থায়ী হতে পারে। 

 

তবে এটাও ঠিক যে বিজেপি যদি মনে করে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তারা জিতে গিয়েছেন সেটা হবে মস্ত বড় ভুল। মোদী নিজেও যে তা বোঝেন না তা নয়। 


এমনকি গোটা দেশে রামকে নিয়ে ভাবাবেগ থাকলেও মোদী নিজেও স্বীকার করেছেন যে, আসন্ন নির্বাচনে একের বিরুদ্ধে এক লড়াই কঠিন হতে পারে। যার জন্য নিজের দিক থেকেও কোনও কিছুতেই খামতি রাখতে চান না তিনি। লোকসভায় নির্বাচনকে সামনে রেখে গোটা ভারত জুড়ে প্রায় শতাধিক নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা যেতে পারে মোদিকে। 


মোদীর পালে হাওয়া জুগিয়েছে রাম মন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিরোধীদের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেওয়া। অন্তত বিশেষজ্ঞদের অভিমত এমনটাই। তাদের মতে, রামমন্দিরের বিরোধিতা করার ঝুঁকি না নিয়ে রামমন্দিরকে ঘিরে যে আবেগ তৈরী হয়েছে তাকে সায় দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হতো। অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকার কারণ হিসাবে বিরোধীদের যুক্তি, বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভোটব্যাঙ্ককে খুশি করতে এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে নরেন্দ্র মোদী রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে পরিণত করেছেন। বিরোধীদের যুক্তি অনেকাংশেই সঠিক, কারণ ঘুরিয়ে এটাই ছিল মোদির উদ্দেশ্য। 


তবে শুধু বিজেপিই নয়, সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ককে খুশি করতে স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেসও বিভিন্ন সময়ে তাদের নিজেদের মত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। 


১৯৫৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু 'হিন্দু পার্সোনাল ল' আইনবদ্ধ করলেও 'মুসলিম পার্সোনাল ল' আইনবদ্ধ করতে অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে শাহ বানো নামে এক স্বামী পরিত্যক্ত মুসলিম মহিলাকে ভরণপোষণ বাবদ মাসিক ৫০০ টাকা প্রদানের বিষয়ে দেশের শীর্ষ আদালত সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিলেও সেই আদেশকে বাতিল করার জন্য আইন পাস করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। 

 

আসলে ভোট জেতার জন্য ধর্ম ব্যবহার করার যে কাজটি কংগ্রেস ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে করেছে বলে অভিযোগ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদীও ঠিক কৌশলে সেই পথই অনুসরণ করে চলেছেন। ভোট যুদ্ধ জিততে এটা সঠিক পদ্ধতি না হলেও, এটাই বকলমে ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 


এমনকি ইউরোপেও, আইনি ও অবৈধ মুসলিম অভিবাসীদের বিরুদ্ধে গভীরভাবে রাজনীতিকরণ করা হয়ে থাকে বলে অভিযোগ। আর এই বিষয়টিই সুইডেন, ইতালি, হাঙ্গেরি, স্পেন এবং অন্য ইউরোপীয় দেশগুলিতে অভিবাসন-বিরোধী সরকার গঠনের দিকে এগিয়ে নিয়েছে।  


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পও অভিবাসন বিরোধী ইস্যুকে সামনে রেখেই তার নির্বাচনী প্রচারণা সেরেছিলেন। ভারতীয় নির্বাচনে যেমন ধর্মকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তেমনই যুক্তরাষ্ট্রে মেরুকরণের সেরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় জাতিগত সমস্যা। 


তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া কেবলমাত্র ধর্ম বা বর্ণের উপর ভিত্তি করে নির্বাচন যে কখনও কখনও বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায় তারও অনেক উদাহরণ রয়েছে ভারতে। ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধী সরকারকে, পরের বছর ১৯৯০ সালে ভিপি সিং সরকার ক্ষমতাচ্যুত হতে হয় ঠিক এই কারণে।  


কথায় আছে, অতিরিক্ত ব্যবহারে ধর্ম নাকি তার নৈতিক ভিত্তি হারায়। ধর্ম তখনই সবচেয়ে শক্তিশালী হয়, যখন সেটি মানুষের জীবনে প্রকৃত উন্নতির সাথে সম্পর্কিত থাকে।


গত কয়েক দশক ধরেই, বিরোধীরা ধর্মকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে আসছে, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণভাবে জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারেনি। মূলত এই কারণেই ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে পরপর দুইটি লোকসভার নির্বাচনে পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়েছে বিরোধীদের। 


আর সেখানেই অন্যদের থেকে এগিয়ে আছেন মোদী। তাঁর কাছে যাদুকরী বিষয় হল ভক্তি ও উন্নয়নের সংমিশ্রণ। অযোধ্যাকে যেমন হিন্দুদের গর্বের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তেমনই অযোধ্যা নগরীকে একটি পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করতে হোটেল, রেস্তোরাঁ, সড়ক এবং নতুন আবাসন সহ অবকাঠামো উন্নয়নের দিকেও সমানভাবে মনোযোগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সর্বশেষ এই সব জল্পনার অবসান ঘটবে নির্বাচনের পর, যার উত্তর দেবে সময়, দেশের ভোটাররা।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad