ন্যাশনাল ডেস্ক, ২৭ জুন ২০২৫: ভারত ও চীনের মধ্যে দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ নিরসন এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্য ভারত চার দফা পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং তাঁর চীনা প্রতিপক্ষের মধ্যে সাম্প্রতিক বৈঠকের পর এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) কাঠামোর অধীনে চীনের কিংডাওতে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে উভয় দেশ সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ করতে সম্মত হয়।
সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকের ফাঁকে রাজনাথ সিং এবং চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাডমিরাল ডং জুনের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে। সূত্রের খবর, এই বৈঠকে রাজনাথ সিং সীমান্ত উত্তেজনা কমাতে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্য চার দফা পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন।
১. ২০২৪ সালের বিচ্ছিন্নতা পরিকল্পনার কঠোরভাবে মেনে চলা
লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় (এলএসি) সামরিক সংঘাত কমাতে ভারত উভয় দেশের সেনাবাহিনী পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহারের পরামর্শ দিয়েছে। ২০২০ সালে গালওয়ান উপত্যকায় সহিংস সংঘর্ষের পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়, যার পরে ভারত ও চীন উত্তেজনা হ্রাসের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সাম্প্রতিক মাসগুলিতে ডেমচক এবং ডেপসাংয়ের মতো এলাকা থেকে সামরিক প্রত্যাহারের পর এই প্রস্তাবটি আরও জোরদার হয়েছে।
২. উত্তেজনা কমানোর জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা- নিয়মিত কূটনৈতিক ও সামরিক সংলাপ
ভারত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা উন্নত করার জন্য নিয়মিত ও স্বচ্ছ সংলাপের ওপর জোর দিয়েছে। বিশেষ প্রতিনিধিদের বৈঠক এবং কর্পস কমান্ডার পর্যায়ের আলোচনার মতো ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে সম্মত হয়েছে দুই দেশ। সম্প্রতি নয়াদিল্লীতে পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্রি এবং চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান ওয়েইডংয়ের মধ্যে বৈঠকেও এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, যেখানে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ বিবেচনা করা হয়েছে।
৩. সীমান্ত সীমানা নির্ধারণ এবং সীমাঙ্কন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা
ভারত সীমান্তে শান্তি বজায় রাখার জন্য যৌথ ব্যবস্থা স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে হটলাইন এবং অন্যান্য যোগাযোগের চ্যানেল শক্তিশালী করা। এই ব্যবস্থা ভবিষ্যতে ভুল বোঝাবুঝি এবং সংঘর্ষ রোধে সহায়তা করবে। উভয় পক্ষ এই দিকে কাজ করার জন্য ইতিবাচক মনোভাব গ্রহণ করেছে।
৪. বিশেষ প্রতিনিধি স্তরের বিদ্যমান ব্যবস্থা ব্যবহার করে নতুন প্রক্রিয়া তৈরি করা
ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধ আরও কার্যকরভাবে পরিচালনা করার জন্য বিশেষ প্রতিনিধি স্তরের বিদ্যমান ব্যবস্থা ব্যবহার করে নতুন প্রক্রিয়া তৈরি করার প্রস্তাব করেছে। এই ব্যবস্থার অধীনে, দুই দেশের বিশেষ প্রতিনিধিরা নিয়মিতভাবে বৈঠক করেন এবং সীমান্ত সমস্যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেন। ভারত এই প্রক্রিয়াটিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য নতুন প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিচ্ছে, যেমন যৌথ পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন, রিয়েল-টাইম যোগাযোগের জন্য হটলাইন স্থাপন এবং স্থানীয় পর্যায়ে সামরিক কমান্ডারদের মধ্যে দ্রুত সমন্বয়ের জন্য প্রোটোকল।
এই সময় রাজনাথ সিং পাকিস্তান-স্পন্সরিত সন্ত্রাসবাদের বিষয়টিও উত্থাপন করেন এবং স্পষ্ট করে বলেন যে, সাম্প্রতিক অপারেশন সিঁদুর এই বিষয়ে ভারতের "নীতিগত অবস্থান" প্রতিফলিত করে। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, ভারত সন্ত্রাসবাদের প্রতি কোনও নমনীয়তা দেখাবে না। বৈঠকের পর রাজনাথ সিং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম 'এক্স'-এ একটি ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, "কিংডাওতে এসসিও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের বৈঠকের সময় চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাডমিরাল ডং জুনের সাথে দেখা হয়। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সম্পর্কিত বিষয়গুলি গঠনমূলকভাবে এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। প্রায় ছয় বছর পর কৈলাস মানসরোবর যাত্রা পুনরায় শুরু হওয়ার বিষয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। এই ইতিবাচক গতি বজায় রাখা এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন জটিলতা এড়ানো উভয় দেশের জন্য প্রয়োজনীয়।"
রাজনাথ সিং এই উপলক্ষে বিহারের একটি ঐতিহ্যবাহী মধুবনী চিত্রকর্মও উপহার দিয়েছেন, যা মিথিলা অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। চীন কর্তৃক প্রকাশিত সরকারী রিডআউট অনুসারে, ভারত স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, তারা চীনের সাথে কোনও সংঘর্ষের পরিস্থিতি চায় না এবং পারস্পরিক সংলাপ ও বিশ্বাস প্রচারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
চীনও বৈঠক সম্পর্কে একটি বিবৃতিও জারি করেছে। চীন বিবৃতিতে বলেছে যে, ভারত চীনের সাথে কোনও ধরণের সংঘর্ষ চায় না এবং সংলাপ পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধি করছে। তবে, এই বৈঠক সম্পর্কে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আসেনি।
এই বৈঠকটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে যখন ভারত এসসিও-র যৌথ নথিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, যা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের কঠোর নীতিকে দুর্বল করে দিত। ২২শে এপ্রিল পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলার কোনও উল্লেখ ছিল না, যেখানে পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসীরা ২৬ জনকে নৃশংস খুন করে। একই সময়ে, চীন এবং পাকিস্তান নথিতে বেলুচিস্তানের কথা উল্লেখ করে পরোক্ষভাবে ভারতকে লক্ষ্যবস্তু করার চেষ্টা করেছিল।
No comments:
Post a Comment