বনেদি বাড়ির পুজো মানেই ঐতিহ্য আর সাবেকিয়ানার মেলবন্ধন। সেইসঙ্গেই রয়েছে পরতে পরতে ইতিহাস, অলৌকিক কাহিনী। তেমনই একটি বনেদি বাড়ির পুজো হল হাওড়ার মাকড়দহ শ্রীমানি পাড়ার শ্রীমানি বাড়ির পুজো। এই পরিবারে দেবী দশভূজা নয়, স্বামী শিবের সাথে হরগৌরী রূপে আসেন। ১৯১৮ সালে এই শ্রীমানি বাড়িতে শুরু হয়েছিল মা দুর্গার পুজো। এবারে ১০৪ বছরে পদার্পণ করল এই পুজো।
পরিবারের সদস্যদের থেকে জানা যায়, বাড়ির পূর্বপুরুষ দুই ভাই- বিশ্বনাথ শ্রীমানি ও হরিপদ শ্রীমানি তখন সবে উঠতি ব্যবসায়ী। মুড়ির ব্যবসা ছিল তাঁদের। ১৯১৮ সাল নাগাদ মুড়ির ব্যবসার সাথে চিনি ও ঘি-এর ব্যবসাতেও সদ্য তাঁরা ভাগ্য পরীক্ষায় নেমেছেন। এমন সময় এক ভোরে বিশ্বনাথ শ্রীমানি (বড় ছেলে)র প্রথম পক্ষের স্ত্রী বাড়ির সদর দরজা খুলে ঝাঁড়ু দিতে গিয়ে দেখেন, সেখানে বসানো দেবী প্রতিমার কাঠামো। হইচই পরে যায় গোটা বাড়ি জুড়ে। সাক্ষাৎ দেবী নিজেই চান তাঁর পুজো হোক, এই ভেবে বাড়ির বড় ছেলে সেই কাঠামো নিয়ে আসেন বাড়ির ভিতরে। পরে সেই কাঠামো অনুযায়ী মৃৎশিল্পীদের দিয়ে প্রতিমা গড়ালে তা রূপ নেয় হরগৌরীর। সেই থেকেই হরগৌরী রূপেই দেবী দুর্গা পুজিত হয়ে আসছেন এখানে।
এখানে নবমীর দিনে বাড়ির সদস্যদের মধ্যে কাদামাটি খেলার ও সন্ধিপুজার পর ধুনো পড়ানোর রীতি ছিল। তবে কালের নিয়মে সেই সব এখন বন্ধ, কেবল রয়ে গিয়েছে স্মৃতির পাতায় আবদ্ধ হয়ে। প্রতি বছর জন্মাষ্টমীতে বাঁশ পুজো করে সূচনা হয় প্রতিমা গড়ার। ষষ্ঠীর দিন বেল গাছে পুজো দিয়ে শুরু হয় দেবীর বোধন। সপ্তমীতে নবপত্রিকা স্নান করিয়ে করা হয় দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা। ২০১৮ সালে শতাব্দী পেরোয় এই পুজো। সেই বছর ১০৮ প্রদীপ জ্বেলে ১০৮ জন মানসিকভাবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের পুজো করা হয়। একসময় এক মণ চালের সাথে একশো নারকেলের তৈরি খাবার ও মনোহরা দিয়ে দেবীকে নৈবেদ্য দেওয়া হত, যা এখনও প্রচলিত, তবে ভাটা পড়েছে নৈবেদ্যর পরিমাণে। এরপরেই বিদায়ের পালা! দশমীতে মালিক পাড়ার ছেলেদের কাঁধে চড়ে দেবী সরস্বতী নদীতে বিসর্জন যান।
উল্লেখ্য, শ্রীমানি বাড়ির সদস্যরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু সারা বছর বিদেশে থাকলেও পুজোর সময় বাড়ির সদস্যরা একত্র হন। গত দু-বছর করোনা আবহে প্রথা ভেঙে প্রতিমা আনা হয়েছিল কুমোরটুলি থেকে। তবে চলতি বছরে করোনা কাঁটা না থাকায় ফের বাড়িতেই পুরনো কাঠামোয় তৈরি হচ্ছে প্রতিমা। নিয়ম মেনেই এবারেও পূজিতা হবেন দেবী।
No comments:
Post a Comment