আজকাল এনার্জি ড্রিঙ্ক আর অচেনা পানীয় নয়। শহুরে যুবক-যুবতীদের কাছে এটি একরকম স্টাইল স্টেটমেন্ট। নামী-দামি ব্র্যান্ডের এই ড্রিঙ্ক হাতেহাতেই ঘোরে। জনপ্রিয় অভিনেতা, খেলোয়াড়, সুপারস্টারদের বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই প্রতিদিন একাধিক ক্যান পান করছেন। বাজার গবেষণা বলছে, ২০২৫ সালে ভারতে এনার্জি ড্রিঙ্ক বিক্রি এক বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে এবং আগামী বছরই তা দ্বিগুণ হতে পারে।
কিন্তু চিকিৎসকরা সতর্ক করছেন, এই পানীয় কতটা বিপজ্জনক হতে পারে তা অনেকেই জানেন না। অতিরিক্ত ক্যাফিন ও চিনি শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। তবে আরও বড় বিপদ লুকিয়ে আছে ভিটামিন বি-৬-এর মধ্যে। মাছ, ডিম, মাংস বা আলুর মতো খাবারে ভিটামিন বি-৬ প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায় এবং মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর জন্য উপকারী। কিন্তু অতিরিক্ত মাত্রায় শরীরে গেলে শুরু হয় ভয়াবহ সমস্যা— ‘পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি’। এতে হাত-পা দুর্বল হয়ে যাওয়া, জ্বালা ভাব, ফোলাভাব, এমনকি হার্টে রক্তসঞ্চালনেও প্রভাব ফেলতে পারে।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় ওষুধ নিয়ামক সংস্থা TGA জানিয়েছে, ভিটামিন বি-৬-এর ওভারডোজে প্রায় ২০০ জন মানুষ অসুস্থ হয়েছেন। অনেক দেশে এর সর্বোচ্চ সহনযোগ্য মাত্রা বেঁধে দেওয়া হলেও এনার্জি ড্রিঙ্কে তার থেকেও বেশি পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে। ব্রিটেনের NHS জানাচ্ছে, প্রতিদিন মাত্র ১.৪ মি.গ্রা. (পুরুষদের জন্য) ও ১.২ মি.গ্রা. (মহিলাদের জন্য) নিরাপদ। অথচ একটি ২৫০ মি.লি. ক্যানেই থাকে প্রায় ৪.৫ মি.গ্রা.। দিনে ২-৩ ক্যান খেলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের টক্সিকোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অ্যালান বুবিসের মতে, উৎসবের দিনে এক আধ ক্যান খাওয়া খুব ক্ষতিকর না হলেও নিয়মিত সেবন ধীরে ধীরে স্নায়ুর ক্ষতি ডেকে আনে। শুধু তাই নয়, চিনি ও ক্যাফিনের আধিক্যে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ডিপ্রেশন ও কিডনি সমস্যা পর্যন্ত হতে পারে। ইতিমধ্যেই ভারতে ৮ কোটিরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, সেখানে এনার্জি ড্রিঙ্ক পরিস্থিতি আরও জটিল করছে।
মহারাষ্ট্র ও পঞ্জাবের মতো কয়েকটি রাজ্যে নাবালকদের কাছে এই পানীয় বিক্রি নিষিদ্ধ করা হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। বাজারে এখনো দেদার বিক্রি চলছে। অনেক পানীয়তে অনুমোদিত সীমার চেয়ে বেশি ক্যাফিনও মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। এমনকি বার ও ক্লাবে মদের সঙ্গে মিশিয়ে পান করাও অত্যন্ত বিপজ্জনক। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি হৃদরোগী ও গাড়ি চালকদের জন্য ভয়ঙ্কর ঝুঁকি তৈরি করছে।
চিকিৎসকরা আরও সতর্ক করছেন— নিয়মিত এনার্জি ড্রিঙ্ক খেলে অজান্তেই মনঃসংযোগের ঘাটতি, মুড সুইংস, অতিরিক্ত ক্লান্তি, কাজের আগ্রহ কমে যাওয়া এমনকি সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা দেয়। কয়েক মাসের মধ্যেই সুস্থ যুবক-যুবতীদের মধ্যেও এ রকম পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার এক ২৩ বছর বয়সী তরুণী এনার্জি ড্রিঙ্কের অতিরিক্ত সেবনে নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর কিডনিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খাবার থেকেই শরীর প্রয়োজনীয় ভিটামিন বি-৬ পেয়ে যায়। তাই অতিরিক্ত এনার্জি ড্রিঙ্ক শরীরে প্রবেশ করালে তা লাভের চেয়ে ক্ষতিই বহুগুণ বাড়ায়। চিকিৎসকদের বার্তা স্পষ্ট— মাঝে মাঝে অল্প পরিমাণে পান করা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকুন। কিন্তু নিয়ম করে প্রতিদিন একাধিক ক্যান সেবন মানেই শরীরের ভেতরে ধীরে ধীরে বিষ জমতে দেওয়া।
No comments:
Post a Comment